শ্রমে-ঘামে বাস্তবায়নের গল্প: নিজেরাই সেতু গড়ছে গ্রামবাসী

মানিকগঞ্জ জেলা প্রতিনিধি,
বছরের পর বছর কেবলই আশ্বাস মিলেছে, কিন্তু সেতু আর হয়নি। অবশেষে ধৈর্যের বাঁধ ভেঙেছে মানিকগঞ্জের সাটুরিয়া উপজেলার কান্দাপাড়া গ্রামের মানুষের। সরকারি দপ্তরের নিষ্ক্রিয়তায় হতাশ না হয়ে, তাঁরা নিজেরাই কাঁধে তুলে নিয়েছেন নিজেদের ভাগ্য বদলের দায়িত্ব। চাঁদা তুলে, স্বেচ্ছাশ্রমে তাঁরা নির্মাণ করছেন স্বপ্নের সেতু। গাজীখালী নদীর বুকে মাথা উঁচু করে দাঁড়ানো পিলারগুলো যেন হার না মানা এক জনগোষ্ঠীর বিজয়স্তম্ভ। এই সেতু নির্মিত হলে কেবল মানিকগঞ্জ নয়, পার্শ্ববর্তী ঢাকা জেলার সঙ্গেও উন্মোচিত হবে যোগাযোগের নতুন দিগন্ত।
দুর্ভেদ্য প্রাচীর যখন গাজীখালী নদী। গ্রামের বুক চিরে বয়ে যাওয়া গাজীখালী নদীটি এতদিন ছিল যোগাযোগের পথে এক দুর্ভেদ্য প্রাচীর। বর্ষা মৌসুমে এর রুদ্ররূপে জনজীবন প্রায় বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়ত। স্কুল, কলেজ, বাজার কিংবা জরুরি প্রয়োজনে হাসপাতাল—সবকিছুই হয়ে যেত দূরতিক্রম্য। কান্দাপাড়াবাসী এই যন্ত্রণাদায়ক পরিস্থিতি আর মেনে নিতে পারেননি। তাই কারও দিকে না তাকিয়ে, নিজেরাই হয়ে উঠেছেন নিজেদের কাণ্ডারি।
এক প্রবীণ গ্রামবাসীর কথায় ফুটে উঠল সম্মিলিত কণ্ঠের প্রতিধ্বনি, “সরকারি সাহায্যের আশায় বসে থেকে আমাদের কয়েক প্রজন্ম কষ্ট পেয়েছে। আমরা চেয়েছি, আমাদের সন্তানেরা যেন এই দুর্ভোগের শিকার না হয়। তাই সবাই মিলে চাঁদা তুলে, শ্রম দিয়ে এই সেতুর কাজ শুরু করেছি। এটা শুধু একটা সেতু নয়, এটা আমাদের ভবিষ্যতের প্রতিজ্ঞা।”
গ্রামের এই মহাযজ্ঞে তরুণদের সঙ্গে কাঁধে কাঁধ মিলিয়েছেন বয়স্করাও। স্থানীয় রাজমিস্ত্রি থেকে শুরু করে সাধারণ কৃষক—প্রত্যেকেই এই নির্মাণকাজের অংশীদার। এলাকাবাসীর বিশ্বাস, এই সেতু কেবল ইট-পাথরের একটি কাঠামো নয়; এটি এই অঞ্চলের আর্থ-সামাজিক মুক্তির সোপান এবং দুই পারের মানুষের মধ্যে গড়ে ওঠা আত্মিক বন্ধনের প্রতীক।
সরেজমিনে দেখা যায়, সেতুটির অভাবে এতদিন স্কুল-কলেজের শিক্ষার্থীসহ গ্রামবাসীকে প্রায় দেড় কিলোমিটার অতিরিক্ত পথ ঘুরে যাতায়াত করতে হতো। এই সেতু নির্মিত হলে সেই অবর্ণনীয় দুর্ভোগের অবসান হবে।
কেন গ্রামবাসী এই কঠিন দায়িত্ব নিজেদের কাঁধে তুলে নিল? এই প্রশ্নের উত্তরে মিশে ছিল দীর্ঘদিনের বঞ্চনা আর ক্ষোভ। স্থানীয় বাসিন্দা মকসেদ বলেন, “স্বাধীনতার পর থেকে কত জনপ্রতিনিধি এলেন-গেলেন, সবাই শুধু প্রতিশ্রুতিই দিয়েছেন। কিন্তু কাজের কাজ কিছুই হয়নি। আশ্বাসের ওপর আর বিশ্বাস নেই। তাই কারও ওপর ভরসা না করে নিজেরাই নিজেদের পথ তৈরি করছি।”
মানিকগঞ্জ সরকারি দেবেন্দ্র কলেজের শিক্ষার্থী রাসেল জানায়, “ঝুঁকিপূর্ণ বাঁশের সাঁকো পার হয়ে কলেজে যেতে হতো। কেউ অসুস্থ হলে তাকে হাসপাতালে নিতে প্রায় দুই কিলোমিটার ঘুরপথ পাড়ি দিতে হতো। এই সেতু আমাদের মুক্তি দেবে।”
সেতু নির্মাণ তহবিলের ক্যাশিয়ার শরিফুল ইসলাম জানালেন, “রোজার ঈদের পর আমরা গ্রামবাসীরা মিলে এই সিদ্ধান্ত নিই। গ্রামের বিত্তশালী থেকে শুরু করে সাধারণ মানুষ—সবাই সাহায্যের হাত বাড়িয়ে দিয়েছেন। ইতিমধ্যে প্রায় ২০ লাখ টাকা সংগ্রহ হয়েছে, যা দিয়ে পিলারের কাজ শেষ হয়েছে। এখন পাটাতন ঢালাইয়ের জন্য আরও অর্থের প্রয়োজন।”
তিনি আরও বলেন, “এটি এখন শুধু একটি সেতু নয়, এটি একটি গণ-আন্দোলন। এই মহৎ উদ্যোগে সামিল হওয়ার দরজা সবার জন্য খোলা আছে। সবার সম্মিলিত প্রচেষ্টায় আমরা দ্রুত কাজটি শেষ করতে পারব।”
এই উদ্যোগকে সাধুবাদ জানিয়েছেন বিভিন্ন মহল। সাটুরিয়া উপজেলা বিএনপির সভাপতি আব্দুল কুদ্দুস খান মজলিস বলেন, “কান্দাপাড়ার মানুষ সাহস এবং স্বনির্ভরতার এক অনন্য প্রতীক স্থাপন করেছে।”
তবে মানিকগঞ্জ বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের নেতা আশরাফুল ইসলাম রাজু একটি গুরুত্বপূর্ণ প্রশ্ন তুলে ধরে বলেন, “যেখানে সাধারণ মানুষকে নিজেদের টাকায় সেতু বানাতে হয়, সেখানে রাষ্ট্র এবং জনপ্রতিনিধিদের ভূমিকা কী? এলাকার মানুষের উচিত নির্বাচনের সময় এই বিষয়গুলো মাথায় রাখা।”
দীর্ঘ ৪০-৫০ বছরের বাঁশের সাঁকোর জোড়াতালি দেওয়া জীবনের এবার অবসান ঘটছে। ১৭ বছরের নিরবচ্ছিন্ন আবেদন-নিবেদনেও যা হয়নি, তা আজ গ্রামবাসীর সম্মিলিত শক্তিতে বাস্তবায়িত হচ্ছে।
তবে এলাকাবাসীর একটি দাবি বেশ তাৎপর্যপূর্ণ। তাঁদের সাফ কথা—এই সেতুর ফিতা কাটবেন কোনো নেতা-মন্ত্রী নন, কাটবেন এই গ্রামেরই কোনো সাধারণ শ্রমজীবী মানুষ। কারণ, এটি কোনো রাজনৈতিক প্রতিশ্রুতি নয়, বরং সাধারণ মানুষের ঘামে-শ্রমে গড়া এক বিজয়ের স্মারক।