ঢাকা ০৩:৫৩ অপরাহ্ন, শনিবার, ০২ অগাস্ট ২০২৫, ১৮ শ্রাবণ ১৪৩২ বঙ্গাব্দ

জুলাই সনদ সই হচ্ছে না আজ

আজকের তরুণকণ্ঠ

২০২৪ সালের গণ-অভ্যুত্থানের পর দেশের অন্যতম আলোচ্য বিষয় ‘জুলাই সনদ’ চলতি মাসের মধ্যেই প্রণয়ন এবং তাতে রাজনৈতিক দলগুলোর সই করার আশা করা হলেও শেষ পর্যন্ত তা হচ্ছে না। আজ বৃহস্পতিবার, জুলাইয়ের শেষ দিন। ঐকমত্য কমিশনের দেওয়া ‘জুলাই জাতীয় সনদ-২০২৫’-এর খসড়া নিয়ে সংলাপে অংশ নেওয়া রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে মতপার্থক্য দেখা দেওয়ায় এবং অন্তত আটটি মৌলিক সংস্কারের বিষয়ে এখনো মতৈক্য না হওয়ায় এ মাসে সনদটিতে সই করা সম্ভব হচ্ছে না।

সংস্কার ইস্যুতে ঐকমত্য সৃষ্টির লক্ষ্যে ছয় মাসের জন্য গঠিত ‘জাতীয় ঐকমত্য কমিশন’-এর মেয়াদ আজ শেষ হওয়ার কথা থাকলেও তা বাড়ানো হচ্ছে। আগের খসড়া নিয়ে প্রধানত বিএনপির সঙ্গে বাংলাদেশ জামায়াতে ইসলামী ও জাতীয় নাগরিক পার্টির (এনসিপি) মতো দলগুলোর মতপার্থক্য দেখা দেওয়ায়, আজ একটি ‘সমন্বিত ও গ্রহণযোগ্য’ খসড়া দলগুলোকে সরবরাহ করবে কমিশন। সব মিলিয়ে সৃষ্ট এক ধরনের সংশয়ের মধ্যেই আজ সকাল সাড়ে ১০টায় দলগুলোর সঙ্গে আবারও সংলাপে বসছে ঐকমত্য কমিশন।

গতকাল বুধবার রাজধানীর ফরেন সার্ভিস একাডেমিতে দলগুলোর সঙ্গে দ্বিতীয় দফার ২২তম বৈঠকের শুরুতে দেওয়া বক্তব্যে ঐকমত্য কমিশনের সহ-সভাপতি অধ্যাপক আলী রীয়াজ বলেছেন, “আশা করছি আগামীকাল (আজ) আমরা একটি সমন্বিত ও গ্রহণযোগ্য খসড়া সনদ সব দলের কাছে তুলে দিতে পারব।” ঐকমত্যের ভিত্তিতে যেসব বিষয়ে সমঝোতা হয়েছে, তার একটি তালিকা গতকালই দলগুলোকে কমিশন দিয়েছে। খসড়ার বিষয়ে দলগুলোর কোনো পরামর্শ বা আপত্তি থাকলে তা আজকের মধ্যে জানানোর অনুরোধ জানিয়ে তিনি বলেছেন, “বৃহস্পতিবারের মধ্যেই আমরা একটি সিদ্ধান্তে পৌঁছাতে এবং আলোচনা শেষ করতে চাই।”

প্রসঙ্গত, গত বছরের অক্টোবরে সংবিধান, নির্বাচন ব্যবস্থা, বিচার বিভাগ, দুর্নীতি দমন কমিশন, প্রশাসন ও পুলিশ সংস্কার কমিশন গঠন করে অন্তর্বর্তী সরকার। গত ফেব্রুয়ারিতে কমিশনগুলো প্রতিবেদন জমা দেয়। পরে সংস্কার প্রশ্নে ঐকমত্য তৈরির লক্ষ্যে প্রধান উপদেষ্টা অধ্যাপক মুহাম্মদ ইউনূসের নেতৃত্বে জাতীয় ঐকমত্য কমিশন গঠন করা হয়। এরপর ছয়টি সংস্কার কমিশনের সুপারিশগুলোকে ঐকমত্য কমিশন দুই ভাগে ভাগ করে। এর মধ্যে আইন-বিধি সংস্কার করে বা প্রশাসনিক সিদ্ধান্তে বাস্তবায়ন সম্ভব এমন অনেকগুলো সুপারিশকে ‘আশু বাস্তবায়নযোগ্য’ হিসেবে চিহ্নিত করা হয় এবং সেগুলো বাস্তবায়নের কাজ চলছে।

অন্যদিকে, ১৬৬টি গুরুত্বপূর্ণ সুপারিশ নিয়ে দলগুলোর সঙ্গে আলোচনা করে ঐকমত্য কমিশন। প্রথম পর্বে (২০ মার্চ-১৯ মে) রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে কমিশন পৃথকভাবে আলোচনা করে। প্রথম পর্বে ঐকমত্য হয়নি—এমন প্রায় ২০টি মৌলিক সংস্কার প্রস্তাব নিয়ে গত ৩ জুন থেকে সব দলকে একসঙ্গে নিয়ে বিষয়ভিত্তিক আলোচনা শুরু করে কমিশন, যা এখনো চলমান। সংস্কারের ক্ষেত্রে এই প্রস্তাবগুলোকে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ হিসেবে চিহ্নিত করা হয়েছে। প্রথম পর্বে ৩২টি এবং দ্বিতীয় পর্বে ৩০টি দল ও জোটের সঙ্গে আলোচনা চলছে।

যে ১২টি বিষয়ে ঐকমত্য

ঐকমত্যের ভিত্তিতে এখন পর্যন্ত যেসব বিষয়ে সমঝোতা হয়েছে, তার একটি তালিকা গতকাল দলগুলোকে দিয়েছে কমিশন। এতে বলা হয়েছে, বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের মধ্যে যেসব বিষয়ে মতভিন্নতা ছিল, সেগুলোর ওপর গত চার মাস ধরে ঐকমত্য কমিশন বৈঠক করেছে। ১৯টি বৈঠক শেষে ১২টি বিষয়ে দলগুলোর সঙ্গে মতৈক্যে পৌঁছানো গিয়েছে। এই ১২টি বিষয় হলো—প্রধানমন্ত্রী পদে ১০ বছরের বেশি না থাকা, সংবিধানের ৭০ অনুচ্ছেদ পরিবর্তন, সংসদীয় স্থায়ী কমিটির সভাপতিত্ব, নির্বাচনী এলাকার সীমানা নির্ধারণ, রাষ্ট্রপতির ক্ষমা সম্পর্কিত বিধান, হাইকোর্টের বিকেন্দ্রীকরণ ও পর্যায়ক্রমে উপজেলায় নিম্ন আদালত স্থানান্তর, জরুরি অবস্থা জারির ক্ষমতা, প্রধান বিচারপতি নিয়োগ, নির্বাচন কমিশনের গঠনপদ্ধতি সংবিধানে যুক্ত করা, ‘স্বাধীন পুলিশ কমিশন’ গঠন এবং প্রধানমন্ত্রীর একাধিক পদে থাকার বিধান সংস্কার।

যে আটটি বিষয়ে এখনো ঐকমত্য হয়নি

দুই ধাপে ধারাবাহিক সংলাপ করেও আটটি মৌলিক সংস্কার প্রস্তাবে দলগুলোর সঙ্গে গতকাল পর্যন্ত মতৈক্যে পৌঁছাতে পারেনি কমিশন। এগুলো হলো—সাংবিধানিক ও সংবিধিবদ্ধ চারটি প্রতিষ্ঠানে নিয়োগ; সংসদের উচ্চকক্ষের নির্বাচন; সংরক্ষিত নারী আসন বাড়ানো ও নির্বাচন পদ্ধতি এবং রাষ্ট্রপতি নির্বাচন পদ্ধতি। এ ছাড়া রাষ্ট্রের মূলনীতি, তত্ত্বাবধায়ক সরকারের গঠন প্রক্রিয়া এবং রাষ্ট্রপতির ক্ষমতা ও দায়িত্বের প্রশ্নে দলগুলো একমত হতে পারেনি।

গতকাল সাতটি ইস্যুর একটিতেও ঐকমত্য হয়নি

গতকাল আলোচনার শুরুতে এর গতি বাড়াতে দলগুলোর সহযোগিতা কামনা করে আলী রীয়াজ বলেন, “যেমনটি আপনারা শুরু থেকেই করে আসছেন, তেমন সহযোগিতার ধারাবাহিকতা আমরা আশা করছি। আপনারা যে দায়িত্ব আমাদের দিয়েছেন, তার মধ্যে সিদ্ধান্ত গ্রহণ একটি গুরুত্বপূর্ণ দিক। আমরা চেষ্টা করছি, এসব বিষয়ে দ্রুত মতৈক্যে পৌঁছাতে এবং আগামীকালের (আজ) মধ্যেই আপনাদের অবহিত করতে পারব।”

তিনি আরও বলেন, সংসদে নারী প্রতিনিধিত্ব-সংক্রান্ত আলোচনায় উল্লেখযোগ্য অগ্রগতি হয়েছে এবং এ বিষয়ে একটি লিখিত খসড়া অংশগ্রহণকারী দলগুলোর কাছে তুলে দেওয়া হবে। প্রাথমিক পর্যায়ে সব দল মৌলিক অধিকার সম্প্রসারণের নীতিগত অবস্থানে একমত হয়েছে। তবে সংবিধানে এ বিষয়ে কী ধরনের পরিবর্তন আসতে পারে, তা নিয়ে কিছু ভিন্নমত রয়ে গেছে। এই প্রক্রিয়ায় বিএনপির দেওয়া সুপারিশ ও আপত্তিগুলো স্পষ্টভাবে কমিশনের কাছে তুলে ধরা হয়েছে, যা আলোচনাকে এগিয়ে নিতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখছে। রাষ্ট্রপতির ক্ষমতা ও দায়িত্ব নিয়ে প্রস্তাব এখনো প্রস্তুত না হলেও অন্য বিষয়গুলোতে দ্রুত সিদ্ধান্তে পৌঁছানোর লক্ষ্যে আলোচনা চলছে বলে আলী রীয়াজ আশাবাদ ব্যক্ত করেন।

গতকাল বৈঠকের শুরুতে স্ক্রিনে সাতটি আলোচ্য বিষয় দেখানো হয়। সেগুলো হলো—সংসদে নারী প্রতিনিধিত্ব; সরকারি কর্মকমিশন, দুর্নীতি দমন কমিশন, মহাহিসাব নিরীক্ষক ও নিয়ন্ত্রক এবং ন্যায়পাল নিয়োগের বিধান; রাষ্ট্রপতির ক্ষমতা ও দায়িত্ব [অনুচ্ছেদ ৪৮(৩)]; রাষ্ট্রপতি নির্বাচন পদ্ধতি ও ইলেকটোরাল কলেজ; উচ্চকক্ষের গঠন, সদস্য নির্বাচনের পদ্ধতি ও এখতিয়ার; নাগরিকের মৌলিক অধিকার সম্প্রসারণ-সম্পর্কিত প্রস্তাব এবং রাষ্ট্রের মূলনীতি।

তবে, বেলা ৩টা থেকে রাত সাড়ে ৭টা পর্যন্ত শুধু নারী আসন নিয়েই আলোচনা হয়েছে। এরপর বিরতি দিয়ে রাত ৮টা থেকে সাড়ে ৯টা পর্যন্ত আবার আলোচনা হলেও এই সাতটি বিষয়ের একটিতেও ঐকমত্য হয়নি। জানা গেছে, সন্ধ্যা সাড়ে ৭টায় আলোচনায় বিরতি দিয়ে কমিশনের সদস্যরা প্রধান উপদেষ্টা অধ্যাপক মুহাম্মদ ইউনূসের সঙ্গে সাক্ষাৎ করেন। সেখান থেকে ফিরে এসে তাঁরা আবারও দলগুলোর সঙ্গে আলোচনায় বসেন।

দলগুলো যা বলল

গতকালের সংলাপে বিএনপির প্রতিনিধি দলের নেতৃত্বদানকারী ও দলটির স্থায়ী কমিটির সদস্য সালাহউদ্দিন আহমদ সাংবাদিকদের বলেন, “বেশির ভাগ সংস্কার প্রস্তাব অধ্যাদেশের মাধ্যমে বাস্তবায়ন করা হচ্ছে। বাকিগুলো নিয়েও খোলামেলা আলোচনা হচ্ছে। এর পরও নির্বাচিত সরকার এলে সেগুলোর বাস্তবায়ন নিয়ে সংশয় থাকা উচিত নয়।”

জামায়াতে ইসলামীর নায়েবে আমির ডা. সৈয়দ আবদুল্লাহ মো. তাহের বলেন, “জুলাই সনদের আইনি ভিত্তি দিতে হবে। এর দায়িত্ব আগামী সংসদের ওপর দেওয়া অর্থহীন। অনেকে বলছেন, আইনি ভিত্তির সম্ভাবনা নেই। আমরা বলব, তাহলে এর দরকার নেই। জুলাই সনদের আইনি ভিত্তি না হলে এতদিনের বৈঠক খাওয়া-দাওয়া আর আলাপ-আলোচনা ছাড়া আর কিছুই নয়। অনেকে বলছেন, অন্তর্বর্তী সরকারের সময়ে আইনি ভিত্তি দেওয়া সম্ভব নয়। এটি ঠিক নয়, কারণ তিনটি পদ্ধতিতে তা দেওয়া যায়: লিগ্যাল ফ্রেমওয়ার্ক, গণভোট ও রেফারেন্ডাম। জিয়াউর রহমান ও এরশাদের আমলে গণভোটে অনেক কিছুই সমাধান হয়েছে।”

জাতীয় নাগরিক পার্টির (এনসিপি) সদস্য সচিব আখতার হোসেন বলেন, “৩১ জুলাইয়ের মধ্যে জুলাই ঘোষণাপত্র দিতে হবে। এ নিয়ে বিন্দুমাত্র ছাড় দেওয়া হবে না। এর ব্যত্যয় ঘটলে ফ্যাসিবাদবিরোধী সব শক্তিকে নিয়ে ঐক্যবদ্ধভাবে তা আদায় করা হবে। আর ঐকমত্য হওয়া বিষয়গুলো নিয়ে যে জুলাই সনদ হবে, সেটিরও আইনি ভিত্তি থাকতে হবে।”

Tag :

পোস্টটি আপনার সোশ্যাল মিডিয়ায় শেয়ার করুন।

প্রকাশ : ০৪:২৭:১৯ পূর্বাহ্ন, বৃহস্পতিবার, ৩১ জুলাই ২০২৫

জুলাই সনদ সই হচ্ছে না আজ

প্রকাশ : ০৪:২৭:১৯ পূর্বাহ্ন, বৃহস্পতিবার, ৩১ জুলাই ২০২৫

২০২৪ সালের গণ-অভ্যুত্থানের পর দেশের অন্যতম আলোচ্য বিষয় ‘জুলাই সনদ’ চলতি মাসের মধ্যেই প্রণয়ন এবং তাতে রাজনৈতিক দলগুলোর সই করার আশা করা হলেও শেষ পর্যন্ত তা হচ্ছে না। আজ বৃহস্পতিবার, জুলাইয়ের শেষ দিন। ঐকমত্য কমিশনের দেওয়া ‘জুলাই জাতীয় সনদ-২০২৫’-এর খসড়া নিয়ে সংলাপে অংশ নেওয়া রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে মতপার্থক্য দেখা দেওয়ায় এবং অন্তত আটটি মৌলিক সংস্কারের বিষয়ে এখনো মতৈক্য না হওয়ায় এ মাসে সনদটিতে সই করা সম্ভব হচ্ছে না।

সংস্কার ইস্যুতে ঐকমত্য সৃষ্টির লক্ষ্যে ছয় মাসের জন্য গঠিত ‘জাতীয় ঐকমত্য কমিশন’-এর মেয়াদ আজ শেষ হওয়ার কথা থাকলেও তা বাড়ানো হচ্ছে। আগের খসড়া নিয়ে প্রধানত বিএনপির সঙ্গে বাংলাদেশ জামায়াতে ইসলামী ও জাতীয় নাগরিক পার্টির (এনসিপি) মতো দলগুলোর মতপার্থক্য দেখা দেওয়ায়, আজ একটি ‘সমন্বিত ও গ্রহণযোগ্য’ খসড়া দলগুলোকে সরবরাহ করবে কমিশন। সব মিলিয়ে সৃষ্ট এক ধরনের সংশয়ের মধ্যেই আজ সকাল সাড়ে ১০টায় দলগুলোর সঙ্গে আবারও সংলাপে বসছে ঐকমত্য কমিশন।

গতকাল বুধবার রাজধানীর ফরেন সার্ভিস একাডেমিতে দলগুলোর সঙ্গে দ্বিতীয় দফার ২২তম বৈঠকের শুরুতে দেওয়া বক্তব্যে ঐকমত্য কমিশনের সহ-সভাপতি অধ্যাপক আলী রীয়াজ বলেছেন, “আশা করছি আগামীকাল (আজ) আমরা একটি সমন্বিত ও গ্রহণযোগ্য খসড়া সনদ সব দলের কাছে তুলে দিতে পারব।” ঐকমত্যের ভিত্তিতে যেসব বিষয়ে সমঝোতা হয়েছে, তার একটি তালিকা গতকালই দলগুলোকে কমিশন দিয়েছে। খসড়ার বিষয়ে দলগুলোর কোনো পরামর্শ বা আপত্তি থাকলে তা আজকের মধ্যে জানানোর অনুরোধ জানিয়ে তিনি বলেছেন, “বৃহস্পতিবারের মধ্যেই আমরা একটি সিদ্ধান্তে পৌঁছাতে এবং আলোচনা শেষ করতে চাই।”

প্রসঙ্গত, গত বছরের অক্টোবরে সংবিধান, নির্বাচন ব্যবস্থা, বিচার বিভাগ, দুর্নীতি দমন কমিশন, প্রশাসন ও পুলিশ সংস্কার কমিশন গঠন করে অন্তর্বর্তী সরকার। গত ফেব্রুয়ারিতে কমিশনগুলো প্রতিবেদন জমা দেয়। পরে সংস্কার প্রশ্নে ঐকমত্য তৈরির লক্ষ্যে প্রধান উপদেষ্টা অধ্যাপক মুহাম্মদ ইউনূসের নেতৃত্বে জাতীয় ঐকমত্য কমিশন গঠন করা হয়। এরপর ছয়টি সংস্কার কমিশনের সুপারিশগুলোকে ঐকমত্য কমিশন দুই ভাগে ভাগ করে। এর মধ্যে আইন-বিধি সংস্কার করে বা প্রশাসনিক সিদ্ধান্তে বাস্তবায়ন সম্ভব এমন অনেকগুলো সুপারিশকে ‘আশু বাস্তবায়নযোগ্য’ হিসেবে চিহ্নিত করা হয় এবং সেগুলো বাস্তবায়নের কাজ চলছে।

অন্যদিকে, ১৬৬টি গুরুত্বপূর্ণ সুপারিশ নিয়ে দলগুলোর সঙ্গে আলোচনা করে ঐকমত্য কমিশন। প্রথম পর্বে (২০ মার্চ-১৯ মে) রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে কমিশন পৃথকভাবে আলোচনা করে। প্রথম পর্বে ঐকমত্য হয়নি—এমন প্রায় ২০টি মৌলিক সংস্কার প্রস্তাব নিয়ে গত ৩ জুন থেকে সব দলকে একসঙ্গে নিয়ে বিষয়ভিত্তিক আলোচনা শুরু করে কমিশন, যা এখনো চলমান। সংস্কারের ক্ষেত্রে এই প্রস্তাবগুলোকে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ হিসেবে চিহ্নিত করা হয়েছে। প্রথম পর্বে ৩২টি এবং দ্বিতীয় পর্বে ৩০টি দল ও জোটের সঙ্গে আলোচনা চলছে।

যে ১২টি বিষয়ে ঐকমত্য

ঐকমত্যের ভিত্তিতে এখন পর্যন্ত যেসব বিষয়ে সমঝোতা হয়েছে, তার একটি তালিকা গতকাল দলগুলোকে দিয়েছে কমিশন। এতে বলা হয়েছে, বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের মধ্যে যেসব বিষয়ে মতভিন্নতা ছিল, সেগুলোর ওপর গত চার মাস ধরে ঐকমত্য কমিশন বৈঠক করেছে। ১৯টি বৈঠক শেষে ১২টি বিষয়ে দলগুলোর সঙ্গে মতৈক্যে পৌঁছানো গিয়েছে। এই ১২টি বিষয় হলো—প্রধানমন্ত্রী পদে ১০ বছরের বেশি না থাকা, সংবিধানের ৭০ অনুচ্ছেদ পরিবর্তন, সংসদীয় স্থায়ী কমিটির সভাপতিত্ব, নির্বাচনী এলাকার সীমানা নির্ধারণ, রাষ্ট্রপতির ক্ষমা সম্পর্কিত বিধান, হাইকোর্টের বিকেন্দ্রীকরণ ও পর্যায়ক্রমে উপজেলায় নিম্ন আদালত স্থানান্তর, জরুরি অবস্থা জারির ক্ষমতা, প্রধান বিচারপতি নিয়োগ, নির্বাচন কমিশনের গঠনপদ্ধতি সংবিধানে যুক্ত করা, ‘স্বাধীন পুলিশ কমিশন’ গঠন এবং প্রধানমন্ত্রীর একাধিক পদে থাকার বিধান সংস্কার।

যে আটটি বিষয়ে এখনো ঐকমত্য হয়নি

দুই ধাপে ধারাবাহিক সংলাপ করেও আটটি মৌলিক সংস্কার প্রস্তাবে দলগুলোর সঙ্গে গতকাল পর্যন্ত মতৈক্যে পৌঁছাতে পারেনি কমিশন। এগুলো হলো—সাংবিধানিক ও সংবিধিবদ্ধ চারটি প্রতিষ্ঠানে নিয়োগ; সংসদের উচ্চকক্ষের নির্বাচন; সংরক্ষিত নারী আসন বাড়ানো ও নির্বাচন পদ্ধতি এবং রাষ্ট্রপতি নির্বাচন পদ্ধতি। এ ছাড়া রাষ্ট্রের মূলনীতি, তত্ত্বাবধায়ক সরকারের গঠন প্রক্রিয়া এবং রাষ্ট্রপতির ক্ষমতা ও দায়িত্বের প্রশ্নে দলগুলো একমত হতে পারেনি।

গতকাল সাতটি ইস্যুর একটিতেও ঐকমত্য হয়নি

গতকাল আলোচনার শুরুতে এর গতি বাড়াতে দলগুলোর সহযোগিতা কামনা করে আলী রীয়াজ বলেন, “যেমনটি আপনারা শুরু থেকেই করে আসছেন, তেমন সহযোগিতার ধারাবাহিকতা আমরা আশা করছি। আপনারা যে দায়িত্ব আমাদের দিয়েছেন, তার মধ্যে সিদ্ধান্ত গ্রহণ একটি গুরুত্বপূর্ণ দিক। আমরা চেষ্টা করছি, এসব বিষয়ে দ্রুত মতৈক্যে পৌঁছাতে এবং আগামীকালের (আজ) মধ্যেই আপনাদের অবহিত করতে পারব।”

তিনি আরও বলেন, সংসদে নারী প্রতিনিধিত্ব-সংক্রান্ত আলোচনায় উল্লেখযোগ্য অগ্রগতি হয়েছে এবং এ বিষয়ে একটি লিখিত খসড়া অংশগ্রহণকারী দলগুলোর কাছে তুলে দেওয়া হবে। প্রাথমিক পর্যায়ে সব দল মৌলিক অধিকার সম্প্রসারণের নীতিগত অবস্থানে একমত হয়েছে। তবে সংবিধানে এ বিষয়ে কী ধরনের পরিবর্তন আসতে পারে, তা নিয়ে কিছু ভিন্নমত রয়ে গেছে। এই প্রক্রিয়ায় বিএনপির দেওয়া সুপারিশ ও আপত্তিগুলো স্পষ্টভাবে কমিশনের কাছে তুলে ধরা হয়েছে, যা আলোচনাকে এগিয়ে নিতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখছে। রাষ্ট্রপতির ক্ষমতা ও দায়িত্ব নিয়ে প্রস্তাব এখনো প্রস্তুত না হলেও অন্য বিষয়গুলোতে দ্রুত সিদ্ধান্তে পৌঁছানোর লক্ষ্যে আলোচনা চলছে বলে আলী রীয়াজ আশাবাদ ব্যক্ত করেন।

গতকাল বৈঠকের শুরুতে স্ক্রিনে সাতটি আলোচ্য বিষয় দেখানো হয়। সেগুলো হলো—সংসদে নারী প্রতিনিধিত্ব; সরকারি কর্মকমিশন, দুর্নীতি দমন কমিশন, মহাহিসাব নিরীক্ষক ও নিয়ন্ত্রক এবং ন্যায়পাল নিয়োগের বিধান; রাষ্ট্রপতির ক্ষমতা ও দায়িত্ব [অনুচ্ছেদ ৪৮(৩)]; রাষ্ট্রপতি নির্বাচন পদ্ধতি ও ইলেকটোরাল কলেজ; উচ্চকক্ষের গঠন, সদস্য নির্বাচনের পদ্ধতি ও এখতিয়ার; নাগরিকের মৌলিক অধিকার সম্প্রসারণ-সম্পর্কিত প্রস্তাব এবং রাষ্ট্রের মূলনীতি।

তবে, বেলা ৩টা থেকে রাত সাড়ে ৭টা পর্যন্ত শুধু নারী আসন নিয়েই আলোচনা হয়েছে। এরপর বিরতি দিয়ে রাত ৮টা থেকে সাড়ে ৯টা পর্যন্ত আবার আলোচনা হলেও এই সাতটি বিষয়ের একটিতেও ঐকমত্য হয়নি। জানা গেছে, সন্ধ্যা সাড়ে ৭টায় আলোচনায় বিরতি দিয়ে কমিশনের সদস্যরা প্রধান উপদেষ্টা অধ্যাপক মুহাম্মদ ইউনূসের সঙ্গে সাক্ষাৎ করেন। সেখান থেকে ফিরে এসে তাঁরা আবারও দলগুলোর সঙ্গে আলোচনায় বসেন।

দলগুলো যা বলল

গতকালের সংলাপে বিএনপির প্রতিনিধি দলের নেতৃত্বদানকারী ও দলটির স্থায়ী কমিটির সদস্য সালাহউদ্দিন আহমদ সাংবাদিকদের বলেন, “বেশির ভাগ সংস্কার প্রস্তাব অধ্যাদেশের মাধ্যমে বাস্তবায়ন করা হচ্ছে। বাকিগুলো নিয়েও খোলামেলা আলোচনা হচ্ছে। এর পরও নির্বাচিত সরকার এলে সেগুলোর বাস্তবায়ন নিয়ে সংশয় থাকা উচিত নয়।”

জামায়াতে ইসলামীর নায়েবে আমির ডা. সৈয়দ আবদুল্লাহ মো. তাহের বলেন, “জুলাই সনদের আইনি ভিত্তি দিতে হবে। এর দায়িত্ব আগামী সংসদের ওপর দেওয়া অর্থহীন। অনেকে বলছেন, আইনি ভিত্তির সম্ভাবনা নেই। আমরা বলব, তাহলে এর দরকার নেই। জুলাই সনদের আইনি ভিত্তি না হলে এতদিনের বৈঠক খাওয়া-দাওয়া আর আলাপ-আলোচনা ছাড়া আর কিছুই নয়। অনেকে বলছেন, অন্তর্বর্তী সরকারের সময়ে আইনি ভিত্তি দেওয়া সম্ভব নয়। এটি ঠিক নয়, কারণ তিনটি পদ্ধতিতে তা দেওয়া যায়: লিগ্যাল ফ্রেমওয়ার্ক, গণভোট ও রেফারেন্ডাম। জিয়াউর রহমান ও এরশাদের আমলে গণভোটে অনেক কিছুই সমাধান হয়েছে।”

জাতীয় নাগরিক পার্টির (এনসিপি) সদস্য সচিব আখতার হোসেন বলেন, “৩১ জুলাইয়ের মধ্যে জুলাই ঘোষণাপত্র দিতে হবে। এ নিয়ে বিন্দুমাত্র ছাড় দেওয়া হবে না। এর ব্যত্যয় ঘটলে ফ্যাসিবাদবিরোধী সব শক্তিকে নিয়ে ঐক্যবদ্ধভাবে তা আদায় করা হবে। আর ঐকমত্য হওয়া বিষয়গুলো নিয়ে যে জুলাই সনদ হবে, সেটিরও আইনি ভিত্তি থাকতে হবে।”