ঐতিহাসিক লংলা ব্রিটিশ সিমেট্রি

তিমির বনিক, মৌলভীবাজার প্রতিনিধি:
মৌলভীবাজারের কুলাউড়া উপজেলার টিলাগাঁও ডানকান ব্রাদার্সের লংলা চা বাগানের রাবার বাগান এলাকায় অবস্থিত লংলা কবরস্থান বা লংলা সিমেট্রি একটি গুরুত্বপূর্ণ ঐতিহাসিক সমাধিস্থল। ব্রিটিশ শাসনামলের চা-বাগানের ঐতিহ্য বহন করে এটি, যেখানে বিদেশি ব্রিটিশ প্ল্যান্টার ও তাদের স্বজনদের সমাধি রয়েছে।
এখানে মোট ২৮ জন ব্রিটিশ খ্রিস্টানকে সমাহিত করা হয়েছে, যারা দেশের চা শিল্পের বিকাশে অনন্য অবদান রেখেছিলেন। ইতিহাস অনুযায়ী, ১৮৫৪ সালে মালনীছড়া চা-বাগানের মাধ্যমে সিলেটে বাণিজ্যিকভাবে চা চাষ শুরু হয়। পরবর্তীতে ১৮৮০ সালের দিকে মৌলভীবাজারে ব্রিটিশরা বিভিন্ন চা-বাগান পরিচালনা করতে শুরু করেন। চা শিল্পের উন্নয়নে অভিজ্ঞ বিদেশি টি-প্ল্যান্টারদের আনা হয়, যারা এখানে বসবাস শুরু করেন। তাদের মধ্যে যারা মৃত্যুবরণ করেছেন, তাদের সমাধিই আজও লংলা চা বাগানের এই সিমেট্রিতে দাঁড়িয়ে আছে ইতিহাসের সাক্ষী হয়ে।
স্থানীয় প্রবীণরা জানান, প্রতিবছর লন্ডন থেকে অভিজাত ব্রিটিশ পরিবারের সদস্যরা এসে তাদের পূর্বপুরুষদের সমাধি দেখে যান। একজন ৭৯ বছর বয়সী প্রবীণ ব্যক্তি জানিয়েছেন, তিনি নিজ চোখে দুইজন ব্রিটিশের দাফন দেখেছেন।
শতাধিক বছর আগে মৌলভীবাজারের জুড়ী, কুলাউড়া, বড়লেখায় চা উৎপাদন শুরু হয়। ব্রিটিশ সাহেবরা জাহাজে করে কলকাতায় আসতেন, সেখান থেকে আসাম হয়ে আসাম বেঙ্গল রেলপথে কুলাউড়া জংশন স্টেশনে যাতায়াত করতেন।
বৃহত্তর মৌলভীবাজারের প্রায় সব চা-বাগানেই ব্রিটিশ রয়্যাল পরিবারের সদস্যরা টি-প্ল্যান্টার হিসেবে কাজ করেছেন। তারা সকলেই ব্রিটিশ রানীর খেতাবপ্রাপ্ত ছিলেন। আসাম ও মৌলভীবাজার-সিলেটের চা-বাগান বিদেশি বাজারে চা রপ্তানিতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখেছিল। আসাম বেঙ্গল রেলওয়ের মাধ্যমে চট্টগ্রাম বন্দর দিয়ে বিদেশে চা রপ্তানি হতো, যা অর্থনৈতিক উন্নয়নের পথ সুগম করেছিল। এর উদ্দেশ্যেই ১৮৯২ সালে আসাম বেঙ্গল রেলওয়ে কোম্পানি প্রতিষ্ঠিত হয়।
ব্রিটিশদের উপস্থিতির কারণেই কুলাউড়া রেলওয়ে স্টেশনটি ব্রিটিশ স্থাপত্যশৈলীতে নির্মাণ করা হয়।
জুড়ীর ধামাই, সুনারূপা, বাহাদুরপুর, রত্না, সাগরনাল, ফুলতলা, কুলাউড়ার ক্লিভটন, গাজীপুর ও লংলা—এসব চা-বাগানের ম্যানেজার, ডাক্তার, প্রকৌশলীসহ বিভিন্ন উচ্চপদস্থ কর্মকর্তা মৃত্যুবরণ করলে তাদের সমাধি হতো লংলা চা-বাগানের সিমেট্রিতে।
লংলা সিমেট্রিতে ১৮৭৫ সাল থেকে শুরু করে ১৮৮৫, ১৯০২, ১৯০৪, ১৯১৪, ১৯৪০ সাল পর্যন্ত ক্রমান্বয়ে বিলিয়ার্ড-এলার্ম জনস, আর পি উলাগান এইচ, পিটার রবার্ট, মার্টিন জ্যাক, এলার্ম জনস, অননেরু মার্টিনসহ বহু ব্রিটিশ প্ল্যান্টারকে সমাহিত করা হয়। কেউ কলেরায়, কেউ বজ্রপাতে, আবার কেউ সাপের কামড়ে মৃত্যুবরণ করেছিলেন।
এই সমাধিক্ষেত্রের প্রতিটি কবরের সঙ্গে জড়িয়ে আছে দুঃখের ইতিহাস। রয়্যাল ফ্যামিলির একজন প্ল্যান্টারের দুই শিশু মাত্র পাঁচ দিনের ব্যবধানে কলেরায় মারা যায়। তাদের পাশাপাশি দুটি কবর রয়েছে—একজনের নাম পিটার রবার্ট এবং অন্যজনের নাম এন্ড্রু ব্রুয়েল। তাদের বাবার শোকগাথা সেই সমাধি ফলকে লিপিবদ্ধ আছে।
সবচেয়ে সাম্প্রতিক দাফন হয়েছে ২০১০ সালে। তিনি ছিলেন ব্রিটিশ ভদ্রমহিলা পদ্মা রেনু রিচার্ড ডলি। তার সন্তান এন্ড্রু নেবিল ও ডেবিট রিচার্ড কবরফলকে একটি মর্মস্পর্শী এপিটাফ লিখে যান।
সিমেট্রির অধিকাংশ কবর মার্বেল পাথর ও সিমেন্টে তৈরি। কোথাও কোথাও পাথরে খোদাই করে নাম, জন্ম-মৃত্যুর তারিখ ও এপিটাফ লেখা আছে। তবে বর্তমানে অনেক সমাধি ভগ্নদশায় রয়েছে এবং সংরক্ষণের অভাব প্রকট।
এই সিমেট্রিকে সঠিকভাবে সংরক্ষণ ও সৌন্দর্যবর্ধনের উদ্যোগ নেওয়া হলে এটি শুধু ইতিহাস রক্ষাই করবে না, বরং একটি গুরুত্বপূর্ণ পর্যটন কেন্দ্র হিসেবেও গড়ে উঠতে পারে। বিদেশি অভিজাতরা এলে তারা যেন বলতে পারেন—“বাংলাদেশে আমাদের স্বজনরা মৃত্যুবরণ করলেও মর্যাদাপূর্ণভাবে সংরক্ষিত আছেন।”
লংলা চা বাগানের খ্রিস্টান কবরস্থান কেবল একটি সমাধিক্ষেত্র নয়, এটি সিলেট অঞ্চলের চা শিল্পের ইতিহাস, ঐতিহ্য ও সংস্কৃতির এক জীবন্ত অধ্যায়। সঠিক সংরক্ষণ ও পরিচর্যার মাধ্যমে এটি আগামী প্রজন্মের কাছে হয়ে উঠতে পারে ইতিহাসের অনন্য দলিল এবং গৌরবময় স্মৃতিচিহ্ন।