তিমির বনিক, মৌলভীবাজার প্রতিনিধি:

মৌলভীবাজারের কমলগঞ্জ উপজেলার রহিমপুর ইউনিয়নের সিদ্ধেশ্বরপুর গ্রামে সংঘটিত একটি নৃশংস হত্যাকাণ্ডের রহস্য উদ্ঘাটন করেছে জেলা পুলিশ। গত ৯ই আগস্ট সকালে নিজ ঘরে আব্দুর রহিম রাফি (২৬) নামে এক ব্যক্তির গলাকাটা মরদেহ উদ্ধার করা হয়।

ঘটনার পরপরই অতিরিক্ত পুলিশ সুপার (ক্রাইম অ্যান্ড অপস) নোবেল চাকমা, শ্রীমঙ্গল সার্কেলের সহকারী পুলিশ সুপার আনিসুর রহমান এবং কমলগঞ্জ থানার ওসি আবু জাফর মো. মাহফুজুল কবিরসহ থানার একটি টিম ঘটনাস্থল পরিদর্শন করে এবং প্রাথমিকভাবে হত্যার কারণ ও অভিযুক্ত ব্যক্তিদের শনাক্ত করতে তদন্ত শুরু করে।

গোপন তথ্য, তথ্যপ্রযুক্তি, এলাকাবাসীর বক্তব্য এবং আচরণ সন্দেহজনক হওয়ায় নিহতের ছোট ভাই রানাকে (ছদ্মনাম, বয়স ১৬) সেদিনই (৯ আগস্ট) জিজ্ঞাসাবাদের জন্য পুলিশি হেফাজতে নেওয়া হয়। পরবর্তীতে নিহতের স্ত্রী এবং আশেপাশের মানুষের দেওয়া তথ্যের ভিত্তিতে তাকে জিজ্ঞাসাবাদ করা হয়। জিজ্ঞাসাবাদের একপর্যায়ে গতকাল (১০ই আগস্ট) সে তার ভাইকে ঘুমের মধ্যে দা দিয়ে কুপিয়ে হত্যার কথা স্বীকার করে।

জিজ্ঞাসাবাদে সে জানায়, ঘটনার আগের দিন অর্থাৎ গত ০৮ই আগস্ট রাত আনুমানিক ০৮টার সময় তার ভাই নিহত রাফির কাছে সে ৫০০ টাকা চায়। রাফি ছোট ভাইকে টাকা না দিয়ে গালিগালাজ এবং দুর্ব্যবহার করে। এই ঘটনায় সে বড় ভাইয়ের ওপর ক্ষিপ্ত হয়। পরের দিন (৯ই আগস্ট) সকাল ০৭টার সময় ঘুম থেকে উঠে ঘাতক ছোট ভাই দেখে তার মা বাড়িতে নেই। বাড়িতে স্ত্রী না থাকায় সেদিন রাফির ঘরের সব দরজাও খোলা ছিল। বাড়িতে কেউ নেই আর রাফি ঘুমিয়ে ছিল—এই সুযোগে আগের রাতের ঘটনায় ভাইয়ের ওপর রাগের বশবর্তী হয়ে খাটের নিচে থাকা ধারালো দা দিয়ে ঘুমন্ত অবস্থায় ভিকটিম রাফিকে ঘাড়ে উপর্যুপরি কুপিয়ে হত্যা করে।

পরবর্তীতে ঘাতক ছোট ভাই হত্যাকাণ্ডে ব্যবহৃত দা বেসিনে ধুয়ে পরিষ্কার করে পুনরায় খাটের নিচে রেখে দেয় এবং তার পরনে থাকা রক্তমাখা লুঙ্গিও খাটের নিচে রেখে দেয়। ঘটনার পর সে বাড়ি থেকে বের হয়ে স্বাভাবিক কার্যক্রম করতে থাকে। তবে শুধু এটাই হত্যাকাণ্ডের পেছনের একমাত্র কারণ নয়।

নিহত রাফির বাবার স্বপ্ন ছিল ছোট ছেলে রানা (ছদ্মনাম) মাদ্রাসায় পড়াশোনা করবে, আলেম হবে। কিন্তু রানার পড়াশোনার প্রতি উদাসীনতা ছিল। রাফিদের বাবা মারা যাওয়ার পর বড় ভাই হিসেবে রাফিই ছিল ছোট ভাইয়ের অভিভাবক। রাফি চাইত তার ছোট ভাই বাড়িতে না থেকে মাদ্রাসায় থেকে পড়াশোনা করবে। কিন্তু তার ভাই মাদ্রাসায় না থেকে বাড়িতেই বেশি থাকত। এসব কারণে অভিভাবক হিসেবে বড় ভাই রাফি প্রায়ই তার ছোট ভাইকে শাসন করত। কিন্তু বড় ভাইয়ের শাসন সে মেনে নিতে পারেনি।

আবার, নিহত বড় ভাই রাফি পরিবারের অমতে প্রেম করে বিয়ে করে। এই বিয়েতে রাফির পরিবার বা আত্মীয়স্বজন কারোরই মত ছিল না। বিয়ের পর থেকে এই বিষয়কে কেন্দ্র করে রাফির স্ত্রীর সাথে তার মা ও ভাইয়ের কিছু টানাপোড়েনের তথ্যও পাওয়া যায়, যা বিয়ের এতদিনেও স্বাভাবিক হয়ে ওঠেনি। প্রায়ই দেবর-ভাবী এবং ভাইয়ের সঙ্গে পারিবারিক অশান্তির তথ্য পাওয়া যায়।

সময়ের সাথে সাথে এই বিষয়গুলো নিয়ে বড় ভাইয়ের ওপর ক্ষোভ বাড়তে থাকে, যা শেষ পর্যন্ত হত্যার মাধ্যমে শেষ হয়।

তার দেওয়া তথ্যের ভিত্তিতে হত্যাকাণ্ডে ব্যবহৃত দা এবং তার ঘরের খাটের নিচ থেকে রক্তমাখা লুঙ্গি উদ্ধার করা হয়েছে।

এই ঘটনায় ভিকটিমের মা মনোয়ারা বেগম বাদী হয়ে কমলগঞ্জ থানায় একটি হত্যা মামলা দায়ের করেছেন। মামলা নং- ০৫, তারিখ-১০/০৮/২০২৪ খ্রি., ধারা- ৩০২/৩৪ পেনাল কোড।